অর্থসংকট দেখিয়ে কক্সবাজারে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। বরাদ্দ কমায় ক্যাম্পে দিন দিন বাড়ছে আর্থসামাজিক অস্থিরতা। নানা ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা। এতে উদ্বিগ্ন কক্সবাজারের স্থানীয় বাসিন্দারা।
রোহিঙ্গা সংকটে ২০১৮ সাল থেকে সহায়তা করছে দাতা সংস্থাগুলো। এখন দাতা সংস্থা থেকে চাহিদা অনুযায়ী সহায়তা মিলছে না। এমন পরিস্থিতিতে ডব্লিউএফপি খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেওয়ায় আরও জমাট বাঁধছে সংকট।
গত বুধবার ডব্লিউএফপি এক বিবৃতিতে বলেছে, চলতি বছর দুই দফা কমানো হয়েছে রোহিঙ্গাদের রেশন বরাদ্দ। প্রথম দফায় পহেলা মার্চ রেশন বরাদ্দ ১২ ডলার থেকে কমিয়ে করা হয় ১০ ডলার। দ্বিতীয় দফায় পহেলা জুন থেকে আরও ২ ডলার কমিয়ে ৮ ডলারে নামিয়ে আনা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, রেশন কমানোই তাদের শেষ অবলম্বন। অনেক দাতা তহবিল নিয়ে এগিয়ে এসেছেন, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। ২০২৩ সালে রোহিঙ্গা মানবিক সংকট পরিকল্পনায় প্রায় ৮৭৫ মিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কিন্তু মাত্র এক চতুর্থাংশ অর্থায়ন হয়েছে। খাদ্যসহায়তা কমিয়ে দেওয়ায় চিন্তিত রোহিঙ্গারা।
উখিয়ার ক্যাম্প-১-এর গর্ভবতী রোহিঙ্গা নারী জামালিকা বলেন, ‘আমি গর্ভবতী নারী। এখন আমার বেশি বেশি খাওয়া উচিত। কিন্তু এখন খাওয়া-দাওয়া ঠিকভাবে করতে পারছি না। কারণ খাদ্য কমে গেছে। কোনো ধরনের পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছি না। পেটের বাচ্চা নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় রয়েছি।’
আরেক রোহিঙ্গা মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘৮৪০ টাকার মধ্যে চাল পেয়েছি ১৩ কেজি, তেল পেয়েছি ১টি আর ১টি লবণের প্যাকেট পেয়েছি মাত্র। এখন কী করব কিছু বুঝে উঠতে পারছি না।’
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা খালেদা বেগম বলেন, ‘এই রেশন দিয়ে সংসার চলে না। এতে আমার স্বামী ও ছেলেরা ক্যাম্পের বাইরে কাজ করতে যেতে বাধ্য হয়। ক্যাম্পের বাইরে গিয়ে মাসে ১০-১৫ দিন মজুরি দেয় তারা। ওই অর্থ দিয়ে সংসার চলে। যারা ক্যাম্পের বাইরে যেতে পারে না, তাদের সংসার চলছে কষ্টে।’
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবাইর বলেন, সম্প্রতি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কমেছে অর্থ বরাদ্দ। রোহিঙ্গারা আগে যে পরিমাণ রেশন পেত, এখন তা পাচ্ছে না। এতে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোতে অর্থসংকট দেখা দিয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে ক্যাম্পে নানা ধরনের অপরাধের পাশাপাশি অস্থিরতা আরও বাড়বে।
তিনি বলেন, নানা জটিলতায় ছয় বছরেরও বেশি সময় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। ইতোমধ্যে দাতা সংস্থাগুলো অর্থ ও খাদ্য বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। ফলে নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে।
উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার ছয় বছর পার হলেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে খাদ্যসহায়তা কমিয়ে দেওয়ায় রোহিঙ্গাদের মাঝে অপরাধপ্রবণতা আরও বেড়েছে। কারণ কাজের সন্ধানে প্রতিনিয়ত রোহিঙ্গারা ক্যাম্পের বাইরে যাচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে। আবার কেউ কেউ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে। এতে আমরা শঙ্কিত।’
কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের খাদ্য বরাদ্দ কমানোর ফলে পুষ্টি, স্বাস্থ্যসহ জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাড়বে অপরাধও। তবে সবকিছুর সমাধান হচ্ছে। যেকোনো মূল্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করা হবে।
মো. মিজানুর রহমান বলেন, এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে আন্তর্জাতিক মহলে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার জানিয়েছেন, ২০১৮ সালে মিয়ানমারকে ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গার তালিকা পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে মাত্র ৭০ হাজার রোহিঙ্গার যাচাই-বাছাই করেছে মিয়ানমার। কিন্তু এখন পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাকেও প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়নি।.সুত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ
পাঠকের মতামত